জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ হাজারেরও অধিক নিয়মিত গ্রাহক রয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সরকারি ব্যাংক হিসেবে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক ও এটিম বুথের সীমিত সুবিধার কারণে তারা প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছেন। শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যার কথা প্রশাসনের কাছে জানিয়েও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
শিক্ষার্থীরা জানান, পরিক্ষার সময় ফর্ম ফিলাপ করে ব্যাংকে কর্মকর্তাদের থেকে স্বাক্ষর নিয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে হয়। এটিএম বুথের সেবার মান খারাপ হওয়াতে বহিরাগত অতিথি বা নতুন শিক্ষার্থী এলে তারা প্রথমেই সমস্যায় পড়ে। ব্যাংকিং সেবা সীমিত থাকায় ছোট ছোট লেনদেনও অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব উদ্যোগে টোকেন ব্যবস্থা বা সময় ভাগ করে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করছেন। ব্যাংক শাখার সীমিত খোলা সময় শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। অনেকে অনলাইনে লেনদেনের চেষ্টা করলেও সীমিত ইন্টারনেট সুবিধা ও মোবাইল ব্যাঙ্কিং সেবা শিক্ষার্থীদের কাছে যথেষ্ট নয়।
কার্যদিবসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে লম্বা লাইন ধরে থাকতে হয়, এতে করে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। এটা তাদের শিক্ষার কাজেও ব্যাঘাত ঘটায়। শিক্ষার্থীরা একাধিকবার প্রশাসনের কাছে ব্যাংকিং সেবা বৃদ্ধি ও এটিম বুথ বাড়ানোর জন্য জানায়। কিন্তু প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে একদল শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এর কাছে লিখিত স্মারকলিপিও প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং সেবা ও কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে স্মারক লিপি জমা দেয়। সেখানে ব্যাংকের সেবার মানে ঘাটতি ও ভোগান্তি,প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও অটোমেশনের অভাব,বৃত্তি সংক্রান্ত তথ্য প্রদানে অবহেলা,অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ,একক ব্যাংক নির্ভরতা ও প্রতিযোগিতাহীনতার কথা তুলে ধরেন।
সমস্যাগুলোর সমাধানে অগ্রণী ব্যাংকের পাশাপাশি অন্তত একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও শিক্ষার্থীবান্ধব বেসরকারি ব্যাংককে ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শাখা বা উপ-শাখা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হোক। মুরাদ চত্বরে অবস্থিত ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ফাস্ট ট্র্যাক বুথটিকে পূর্ণাঙ্গ শাখায় রূপান্তর করা হোক।ব্যাংকিং সেবার গুণগত মান উন্নয়নে একটি যৌথ তদারকি কমিটি গঠন করা হোক। বৃত্তির তথ্য এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে পুনরায় সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক। শিক্ষার্থীদের উপর আরোপিত অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ বাতিল করে স্বচ্ছ, যৌক্তিক এবং শিক্ষার্থী-সুলভ চার্জ কাঠামো প্রণয়ন করার সুপারিশ দেয়।
তাঁদের মধ্যে একজন বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মোলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতান মুলক শুভ বলেন, একটি ট্রানজেকশন করতে তিন কর্মদিবস সময়ের প্রয়োজন হয়। শুধুমাত্র মোবাইল ব্যাংকিং এ তাৎক্ষণিক সেবা দিতে পারে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের অন্য সেবার ক্ষেত্রে সবকিছু হাতে করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর ব্যাতীত খুব কম ক্যাম্পাস আছে যেখানে একটি ব্যাংকের মাধ্যমে সকল আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছোটবড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একাধিক ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বরে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ফাস্ট ট্রাক ব্রাঞ্চটাকে সাব ব্রাঞ্চে রূপান্তরিত করা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অগ্রণী ব্যাংকের অটোমেশন সিস্টেম নেই। ব্যাংকে গ্রাহকদের সেবাগুলোকে আরো সিস্টেমেটিক উপায়ে করা যায় কিনা সেটি কর্তৃপক্ষকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি করতে পারে তাহলে সকলের জন্য ভালো। তবে আমার মনে হচ্ছে না এই ব্যাংকের মাধ্যমে অটোমেশন সম্ভব।
জাকসুর সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক আহসান লাবিব বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং সেবাকে সহজতর করতে ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। ব্যাংক এর ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা যেতে পারে। এর ফলে এটার নির্দিষ্ট টাইম টেবিল থাকবে না, দিনের যেকোনো সময়ে ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া যাবে এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে। এই বিষয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করবো।
জাকসুর জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে শিক্ষার্থী এই দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়ানো এবং ব্যাংক সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে আরো সহজ করা। সেহেতু শিক্ষার্থীদের কাজ সহজ করার ক্ষেত্রে অন্যকোন ব্যাংক আনা হোক বা এই ব্যাংকের কার্যক্রম ভালো করার মাধ্যমেই হোক যে পদক্ষেপই নেয়া হবে সেটাকেই স্বাগত জানাবো।
এ বিষয়ে জাকসু ভিপি আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি দূরীকরণে ডাচ বাংলা ব্যাংকের যেই ফাস্ট ট্রাকটি আছে সেটিকে ব্যাঞ্চে রূপান্তর করার জন্য প্রশাসনকে জানাবো।
বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ অথবা ২০১৬ সালে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ফারজানার আমলে সোনালী ব্যাংকের শাখা স্থাপনের কাজটি প্রায় শেষের দিকে এসে অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যকোন সরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা না গেলেও অন্তত প্রাইভেট কোন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন।
এটিম বুথ বন্ধ থাকার বিষয়ে দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, অনেক কর্মচারী রয়েছে যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে রাখে। মাসের শুরুতে বেতন পাওয়া মাত্রই তারা ব্যাংকে না এসে এটিম বুথের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে নেয়। ফলে ব্যাংক সেসব লোনের অর্থ ফেরতের সময় পায় না। এক্ষেত্রে বেতন দেয়ার পর শুরুর দিকে কিছু সময় এটিএম বুথ বন্ধ রাখে বলে জানতে পারি।
বিষয়টি নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুর রহমান জানান, ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ ভবনটির ভিতরে জায়গা সংকুলান হয় না। জায়গা সংকটের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতিরিক্ত ভীড় হয়ে যায়। উপরের তলায় পরিক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসটির আমাদের কাজের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা রয়েছে। আমাদের জনশক্তির কোন ঘাটতি নেই। বরাদ্দ দেয়া হলে শিক্ষার্থী,শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য পৃথক পৃথক ডেক্স বাড়িয়ে সেবার মান বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবো। মাসের শুরুর দিকে এটিম বুথে অতিরিক্ত চাপ থাকাতে সাময়িক ত্রুটি তৈরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম আব্দুর রব বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পট্রলার ও অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের সাথে আলোচনা করেছি। ব্যাংকে শিক্ষার্থীরা যেসব কাজ অনলাইনে করার মতো সেগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যবস্থাপককে জানানো হয়েছে। এর আগে সোনালী ব্যাংকে ক্যাম্পাসে আনার চেষ্টা করা হলেও পরে তা অনুমোদন পায়নি। জাকসু প্রতিনিধি ও ভিসি স্যারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
তিনি আরো জানান, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে জানতে পারেন অন্য ব্যাংক থাকলে কাজের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
তবে শিক্ষার্থীরা বলেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় ক্যাম্পাসগুলোতে বিশাল গ্রাহকদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সেখানকার ব্যাংকগুলোতে জটিলতা লক্ষ্য করা যায়নি।
উল্লেখ্য যে, দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলামের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য একটি ব্যাংক অনুমোদন পাওয়ার শেষ মুহুর্তে অজানা কারনে অনুমোদন পায়নি।
ব্যাংকের সেবার মান সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ বলেন, আমাদের এখানের অগ্রণী ব্যাংকের সেবার খুব নিন্ম পর্যায়ের। ব্যাংকটার সেবার উন্নত করা প্রয়োজন। আমি ব্যাংক সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবস্থাপকের সাথে কথা বলবো। তবে সীমিত জায়গা এতো বড়ো কমিউনিটির জন্য পর্যাপ্ত নয়। এখানে অন্যকোন বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন করা গেলে বিশাল কমিউনিটির জন্য বিকল্প সেবা নেয়ার ক্ষেত্রটা বৃদ্ধি পাবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, আমাদের ত্রিশ হাজারেরও অধিক গ্রাহক একটি ব্যাংক থেকে উন্নতমানের সেবা নেয়া দুষ্কর। আগে কোন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। তবে শিক্ষার্থীদের কল্যানে বর্তমান ব্যাংকটির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে জায়গা বরাদ্দ দেয়া অথবা নতুন কোন ব্যাংক অনুমোদনের ব্যাপারে প্রশাসনিক সভাতে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, প্রকৃত পদক্ষেপ ছাড়া সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। প্রশাসন শুধু আশ্বাস না দিয়ে অতিরিক্ত এটিম বুথ স্থাপন, ব্যাংক শাখা সম্প্রসারণ এবং ডিজিটাল লেনদেন সুবিধা উন্নয়নের মাধ্যমে কার্যকর সমাধান নেবে।
















