নিচতলায় ছিল আগুনের তীব্রতা, ওদিকে ভবনের ছাদ তালাবন্ধ। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটকা পড়েন শ্রমিকরা। পরে বিষাক্ত গ্যাসে হয়ে পড়েন অজ্ঞান। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন একে একে পুড়িয়ে কয়লা করে দেয় ১৬টি প্রাণ।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে লাগা অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের কারণ সম্পর্কে এসব কথা জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি জানিয়েছেন, ‘নিহত সবার মরদেহ পোশাক কারখানার ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ভবনের নিচতলায় আগুনের তীব্রতা থাকায় এবং ছাদে ওঠার দরজা দুটি তালা দিয়ে বন্ধ থাকায় অনেকেই ভবন থেকে বের হতে পারেননি। ফলে শ্রমিকরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটকে বিষাক্ত গ্যাসে অজ্ঞান হয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।’

মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ১১টা ৫৬ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রথমে পাঁচটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে, পরে আরও সাতটি ইউনিট যোগ দেয়। সবমিলিয়ে ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
এদিন দুপুরে প্রথমে কেমিক্যালের গোডাউনে আগুন লাগার পর চারদিকে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দ্রুত আক্রান্ত হন ঠিক পাশের চারতলা পোশাক কারখানার ভবনটির কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাশের কারখানার আগুন দ্রুত সরু গলির ওপারের পোশাক কারখানার ভবনের নিচে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে পোশাক কারখানার কর্মীরা নিচে নামতে পারেননি। আবার ছাদের দরজায় তালা থাকায় ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ওপরেও যেতে পারেননি।

উদ্ধারকারী কর্মকর্তাদের ধারণা, এ কারণে কর্মস্থলেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন পোশাক কারখানাটির ওপর তলায় থাকা কর্মীরা। পরে সেই ভবনের ওপরের দিকে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়লে পুড়ে অঙ্গার হতে হয় তাদের।
রাসায়নিক গুদামের আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে না আসার তথ্য দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সেখানেও মৃতদেহ থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন কোনোটিরই অনুমোদন ছিল না। কোনো ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনাও ছিল না।’
তাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও জানান, ‘মরদেহগুলো অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। চেহারা দেখে কিংবা অন্য কোনোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।’

অন্যদিকে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে পোশাক কারখানাটিতে আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ-এর সদস্যভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা, নাম শাহ আলী ওয়াশিং লিমিটেড।
অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ১৬ শ্রমিকের মৃত্যুর পাশাপাশি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিন অগ্নিকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্ধানে ঘটনাস্থল এবং তার পাশের সড়কগুলোতে জড়ো হন তাদের স্বজনরা। এসময় অনেকের হাতে তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যের ছবি দেখা যায়। কয়েকজনকে আবার দেখা যায় আহাজারি করতে।

এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে সেখানে ভিড় জমায় উৎসুক জনতাও। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ এবং সেনাবাহিনীও। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও অনেকে কাজ করছেন। তারা হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের হাসপাতালের মর্গ এবং জরুরি বিভাগে যাওয়ার অনুরোধ করছেন।
এদিক ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এই শোকের সময়ে তাদের পরিবারের পাশে আছি।’ তিনি অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তার নির্দেশ দেন।
















