ক্ষমতার মসনদে বসে পিতৃতন্ত্র নারীকে নিজের প্রতিপক্ষ মনে করে সর্বতোভাবে দমিয়ে রাখতে চায়। যাতে প্রতিস্পর্ধার ফুলকিটুকুও ছিটকে বেরোতে না পারে। যেখানে পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি হয় অজস্র স্বপ্ন, সেখানেই জন্ম নেয় এক অনিবার্য দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা থেকেই কলম ধরেন সাহিত্যিক বানু মুশতাক। তিনি শুধু গল্প বলেন না, তিনি সেইসব অশ্রুত কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠেন, যে নারীরা প্রতিদিন তাদের দুঃখগাথা নিয়ে আসেন তার দরবারে-কখনো সমাজকর্মী, কখনো আইনজীবী হিসাবে। তার অক্ষরমালা তাই শুধু সাহিত্য নয়, তা যেন এক জ্বলন্ত মশাল, যা আলোকপাত করে সমাজের অন্ধকারতম কোণগুলোতে। চলুন, তারই মুখ থেকে শুনে নেওয়া যাক সেই যাত্রাপথের কথা, যে পথ তাকে সাধারণের যন্ত্রণা থেকে অসাধারণ সাহিত্যের স্রষ্টা করে তুলেছে। অনুবাদ-মেজবাহ উদ্দিন
আপনি কথাসাহিত্যকেই কেন বেছে নিলেন?
: আর কী-ই বা করতে পারি? যে বিপদগ্রস্ত নারীরা আমার কাছে রাশি রাশি উদ্বেগ আর দুঃখ নিয়ে আসেন, তাদের যন্ত্রণা লাঘব করার মতো ক্ষমতা তো আমার নেই। সমাজকর্মী এবং আইনজীবী হিসাবে আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি, তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু একইসঙ্গে আমি চেয়েছি তাদের দুর্দশার কথা নথিভুক্ত করতে, গোটা বিশ্বকে দেখাতে যে, পুরুষতন্ত্র আর কতকাল এভাবে নারীদের ওপর সহিংসতা চালাবে! এটা এবার থামাতেই হবে।
কিন্তু এর জন্য তো শুধু শোনার চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। এমন নির্ভুলতার সঙ্গে লেখার জন্য অন্য কিছুর দরকার হয়।
: আমি তাদের সমস্যাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারি না। ভূতের মতো সেগুলো আমাকে তাড়া করে ফেরে, এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয় না। আমি তাদের উদ্বেগের কণ্ঠস্বর হতে চাই, তাদের সব যন্ত্রণার কথা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। বলতে চাই, এ নারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাদের মুক্তি দিতে হবে, তাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের ওপর এ লাগাতার নির্যাতন এবার বন্ধ হোক। কাউকে তো ‘না’ বলতেই হবে। আমি সেই কথাই বলছি।
আপনার গল্পে দেখানো ঘটনাগুলোর সাধারণ এবং তাতে যে সহিংসতার চিত্র ফুটে ওঠে, তা কিন্তু সব সময় শারীরিক নয়
: নারীদের সমস্যার পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষদের কথাও এখানে রয়েছে। আমি দেখাতে চেয়েছি যে, প্রান্তিক মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ-তারাও মানুষ। তাদেরও নিজস্ব সমস্যা, সংকট রয়েছে। আমি তাদের অভিজ্ঞতাগুলো গোটা বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি, যাতে এ ব্যবধান কমে, একটা নতুন জানালা খুলে যায়।
লেখকরা তাদের লেখায় নিজেদের কিছু অংশ অথবা নিজেদের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে দেন। আপনার গল্পে আত্মজৈবনিক উপাদানের ঝলক রয়েছে বললে খুব কি বাড়িয়ে বলা হবে?
: আমার গল্পে তেমন কোনো গুরুতর আত্মজৈবনিক উপাদান নেই। তবে নারীরা প্রতিদিন আমার সঙ্গে যে অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নেন, সেটাই আমার গল্পের কাঁচামাল। সমাজকর্মী ও আইনজীবী হিসাবে প্রতিদিন আমার অনেক নারীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন, কখনো আমি তাদের পরামর্শ দিই, কখনো আইনি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি। তারা আমাকে একজন পরামর্শদাতা হিসাবে দেখেন এবং এমন অনেক কথা বলেন, যা হয়তো একটা আইনি খসড়া তৈরির জন্য জরুরি নয়।
বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তি কি অপ্রত্যাশিত ছিল?
: ঘোষণার আগের মুহূর্তগুলো ছিল টানটান উত্তেজনাপূর্ণ, অবিস্মরণীয়। লেখক ম্যাক্স পোর্টার যখন ‘হার্ট ল্যাম্প’কে বিজয়ী ঘোষণা করলেন, তখন একটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো পরিবেশ তৈরি হলো। আমার আত্মীয়স্বজনসহ উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করলেন। মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার জোনাকি একসঙ্গে একটাই আকাশকে আলোকিত করে তুলেছে। আমি সত্যিই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
এ পুরস্কারের তাৎপর্যকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
: কখনো ভাবিনি আমার পৃথিবীর কোণের গল্পগুলো এতদূর পাড়ি দেবে। এটা ভারতের সব আঞ্চলিক ভাষার লেখকদের জন্য একটা বিশেষ মুহূর্ত। এটা বৈচিত্র্যেরও জয়। এ পুরস্কার সেই অগণিত নারীদের স্বীকৃতি দেয়, যাদের জীবনের প্রতিধ্বনি এ গল্পগুলোতে অনুরণিত হয়েছে। দীপা ভাস্তিকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, অনুবাদের মাধ্যমে আমার শব্দগুলোকে ‘নতুন জীবন’ দেওয়ার জন্য।
হুমকি এবং সামাজিক বিভাজনের মধ্যে একজন লেখক হিসাবে আপনার ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?
: একজন সমালোচনামূলক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে আমাকে একঘরে হওয়া, হুমকি এবং মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখকের কাজ হলো শৈল্পিকভাবে অবিচারের দলিল তৈরি করা, কোনো রকম উপদেশ না দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক কারসাজি এবং নারীদের সংগ্রামকে উন্মোচন করা। আজকের এ বিভক্ত পৃথিবীতে, যেখানে নারীদের ওপর নজরদারি বাড়ছে এবং ঘৃণানির্ভর রাজনীতি মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেখানেও আমি আশাবাদী। ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয় এবং সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
প্রথমবারের মতো একটি ছোটগল্প সংকলন বুকার পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হওয়াটাকে কীভাবে দেখছেন?
: ছোটগল্প প্রায়শই উপন্যাসের চেয়ে কম মনোযোগ পায়, কিন্তু আমি এ আঙ্গিকটি ভালোবাসি। প্রতিটি সাহিত্য আঙ্গিকের নিজস্ব স্থান রয়েছে। উপন্যাসকে ছোটগল্পের ওপরে স্থান দেওয়া বা তাদের মধ্যে কোনো স্তরবিন্যাস তৈরি করা অনুচিত।
এই পুরস্কার কন্নড় সাহিত্যের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?
: এ পুরস্কার কন্নড় ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। যদি আরও কন্নড় সাহিত্যকর্ম ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়, তবে আমরা আমাদের গল্পগুলোকে বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। এ গল্পটি আমার এই বিশ্বাসের প্রতি একটি প্রেমপত্র যে, কোনো গল্পই কেবল স্থানীয় নয়। আমার গ্রামের বটগাছের তলায় জন্ম নেওয়া একটি গল্পও সারা বিশ্বে তার ছায়া ফেলতে পারে।
আপনার গল্পগুলো জাতি, শ্রেণি এবং লিঙ্গভিত্তিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এর অনুপ্রেরণা কী?
: সংকলনটির ইংরেজি সংস্করণটি আমার কন্নড় সংকলন ‘এদেয়া হানাতে’ (হৃদয় প্রদীপ)-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এর উপাদান জীবন থেকেই নেওয়া। আমি মানুষ ও সমাজকে পর্যবেক্ষণ করি। খবরের কাগজ থেকেও আমি মর্মস্পর্শী মানবিক গল্প সংগ্রহ করি। আইনজীবী ও মধ্যস্থতাকারী হিসাবে আমি প্রায়শই বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দিই, বিশেষ করে নারীদের। পরামর্শ দেওয়ার সময় তারা কেবল তাদের আইনি সমস্যাই নয়, তাদের মানসিক টানাপড়েনের কথাও বলেন। আমি দুটো আলাদা নোটবুক রাখি-একটা মামলার জন্য, অন্যটা তাদের ব্যক্তিগত কাহিনির জন্য। এ আবেগঘন অভিজ্ঞতাগুলোই আমার গল্পের ভিত্তি তৈরি করে। আমি তাদের যন্ত্রণার সঙ্গে একাত্ম বোধ করি এবং সেটাই আমার সৃজনশীল প্রকাশকে রূপ দেয়।
আন্তর্জাতিক পাঠকদের জন্য গল্পগুলো কীভাবে নির্বাচন করলেন?
: এ নির্বাচন ছিল একটি যৌথ প্রয়াস। অনুবাদক দীপা আমার পাঁচটি সংকলন পড়েছিল এবং যে গল্পগুলো ওকে নাড়া দিয়েছিল, সেগুলো বেছে নিয়েছিল। আমিও কয়েকটার কথা বলেছিলাম। ও বলত, ‘এই কারণে এ গল্পটা আমার খুব ভালো লেগেছে’। আমি ওর পছন্দকে সম্মান জানিয়েছি, কারণ ও যদি এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়, তাহলে অন্যরাও হবে। এ গল্পগুলোর অনুভূতি সর্বজনীন। ভারত থেকে জাপান বা ফ্রান্স-সব জায়গার নারীরাই একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও অধীনতার শিকার হন। যখন তারা এ গল্পগুলো পড়েন, তখন নিজেদের চিনতে পারেন। এটাই এ সংকলনের মূল সুর।
অনেক গল্পেরই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রান্তিক কণ্ঠস্বর। সামাজিক পরিবর্তনে সাহিত্যের ভূমিকা কী?
: একটা ঘটনা বলি। উপকূলবর্তী অঞ্চলের এক মুসলিম নারী সম্প্রতি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি তার দুর্দশার কথা বললেন এবং জানালেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন না এরপর কী করবেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হাসানে এত আইনজীবী থাকতে তিনি আমার কাছে কেন এলেন। তিনি বললেন, তিনি আমার একটি গল্প অবলম্বনে তৈরি ‘হাসিনা’ ছবিটি দেখেছিলেন, যেটি তিনটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। কয়েক দশক পর তিনি আবার ছবিটি দেখেন এবং সেটি তাকে কিছু উত্তর দেয়। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আপনিই সঠিক ব্যক্তি যিনি আমায় সাহায্য করতে পারবেন।’ তখনই আমি অনুভব করেছিলাম যে আমার লেখা সত্যিই কোনো পরিবর্তন এনেছে।
বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের স্বল্পসংখ্যক নারীদের একজন হিসাবে, সেই অভিজ্ঞতা আপনার কণ্ঠস্বরকে কীভাবে গড়ে তুলেছে?
: ১৯৭০-এর দশকে হাসানে বান্দায়া আন্দোলনের উত্থান ঘটে, যা ছিল নারী অধিকার, দলিত সাহিত্য এবং কন্নড় ভাষায় মুসলিম সাহিত্য সংবেদনার মতো অনন্য ধারণার কেন্দ্রবিন্দু। এ আন্দোলন কর্ণাটক তথা সমগ্র ভারতে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্ম দিয়েছিল, যা রাজনীতি ও সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। হাসানে সাংবাদিক হিসাবে আমি প্রতিদিনের বিক্ষোভ এবং বর্ষীয়ান নেতাদের প্রচেষ্টা স্বচক্ষে দেখেছি। এ অভিজ্ঞতাগুলো আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখাকে গড়ে তুলেছে। এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে আমার ভাবনাগুলোই আমার অনেক সাহিত্যকর্মের অনুপ্রেরণা।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
