ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ সৃষ্ট কলকাতার তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মুসলমানের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বর্ণবাদী গবেষকরা গর্ব করে এর নাম রাখেন ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’। এ ঘটনার ৮২ বছর পর ১৮৯৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। নজরুলের জন্মের মধ্য দিয়ে সার্বিক অর্থে এ দেশের সত্যিকারের জাগরণের দ্বার উন্মোচিত হয়।
১৮৯৯ থেকে ১৯২১ এই ২২ বছরকে বলা যায় নজরুল প্রতিভার প্রস্তুতিকাল। আমরা দেখব এই ২২ বছরে বিচিত্র সব পথে অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য পরিক্রমণের মাধ্যমে অর্জন করেছে বিপুল বিশাল অভিজ্ঞতা। আর নজরুল ক্রমাগত নজরুল হয়ে উঠেছেন। দেখেছেন সত্যিকারের সংকটটা কোথায়। সমস্যা কোথায়। গণমানুষের বেদনার জায়গাটা কোথায়। কেন দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। দেশের ও জনগণের শত্রু কারা। নজরুল তার অসীম সংবেদনশীলতা ও দরদের রেণুমাখা হৃদয় দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন সবকিছু। তারপর অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার ও সর্বগ্রাসী পঠনপাঠনের মাধ্যমে খুঁজে বের করেছেন সমাধানের পথ। তিনি যে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তা-ও কোনো চাকুরির অন্বেষণে নয়। তিনি গিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লব করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। এ কারণেই যুদ্ধ ফেরত নজরুল কোনো সরকারি চাকুরির ধার না ধেরে নেমে গেছেন সংগ্রামের ময়দানে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে নির্মূল করার জন্য মোকাবিলার পথে।
দুই.
ব্রিটিশবিরোধী খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের গনগনে দিনে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব। নজরুল জানতেন কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। কোথায় হানতে হবে আঘাত। ফলে এলাম দেখলাম জয় করলামের মতো হয়ে গেল বিষয়টি। কারণ যে কবির জন্য, যে সাহসের জন্য, যে অনুপ্রেরণার জন্য, যে যুদ্ধ ঘোষণার একজন নকিবের জন্য জাতি অপেক্ষা করছিল-সেই প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত কবি ছিলেন নজরুল।
সাহিত্যে তখন আগুনের ফুলকি ছিটাচ্ছেন একা নজরুল। জীবন যৌবন বাজি রেখে উদিত হয়েছেন ধূমকেতুর মতো। আগুনের লাভা স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন ভাষা, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, জনজীবনে। যদি নজরুলের জন্ম না হতো, তাহলে বাংলাভাষীরা কোনোদিন জানতেও পারত না, তার ভিজে স্যাঁতসেঁতে জলমগ্ন ভাষার ভেতরে লুকিয়ে ছিল ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী ক্ষমতা। বিসুভিয়াসের মতো উত্তপ্ত লাভা উদ্গিরণের ভয়াল তাণ্ডব। স্বর্গ-মর্ত্য করতলে নেওয়া গতির উন্মাতাল প্রবাহ। অচিরকালের মধ্যে নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির মূল কণ্ঠস্বর। জাতির নায়ক। মাত্র ৮ বছর সময়ের মধ্যে ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর সব কীর্তি স্থাপন করে স্তম্ভিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে।
নজরুলের আবির্ভাবের ৮ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ৩০ বছরের নজরুলের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় কবির সম্মান। আর অনুষ্ঠানের সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ঘোষণা করলেন, ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি জনগণ যেমন রুশো ভলটেয়ারের লেখা পাঠ করে এক একজন অতি মানবে পরিণত হয়েছিল, তেমনি নজরুলের লেখা পাঠ করেও আমাদের জনগণও একদিন অতি মানবে পরিণত হবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখনো নজরুলের গান গেয়ে যুদ্ধে যাব, কারাগারে যাওয়ার সময়ও গাইব নজরুলের গান। এরও বহু পরে মওলানা ভাসানী যখন শোষণবিরোধী সংগ্রাম চালাচ্ছেন তখন তিনি বলেছিলেন, অন্য অনেককে ছাড়া আমাদের চলে কিন্তু নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না। কারণ নজরুলের প্রতিটি রচনা আসলে এক একটি যুদ্ধ ঘোষণা। এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের জনগণের পরম পাথেয় নজরুলের রচনা, তার কবিতা ও সংগীত।
আজার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ এবং মওলানা ভাসানীর প্রতিটি কথাই সত্যে পরিণত হয়ের্ছিল। এখনো তা ধ্রুবতারার মতো অনির্বাণ দীপ্তি নিয়ে বিরাজ করছে।
নজরুল বাংলা সাহিত্যেও সদর অন্দর আমূল বদলে দিলেন। তার আগে তার মতো করে কালবৈশাখী ঝড়ের দাপট নিয়ে, জীর্ণ দীর্ণ ম্যাড়মেড়ে পুরাতন, জামাধরা, ধামাধরা সাহিত্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নির্মাণ করেন বীর্যবান তেজতপ্ত নতুন এক পৃথিবী। জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে নির্মাণ করলেন এক অজর অমর অবিনাশী শিল্পের ভুবন। ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়ল সাহিত্যে, সংগীতে, রাজনীতিতে। সে সময় বাংলা ভাষার বেশিরভাগ কবি লেখক বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা ছিল মেরুদণ্ডহীন, নির্বিষ সরিসৃপের মতো। হয় আত্মরতি, শাসকদের মোসাহেবি, নয়তো নান্দনিকতার মুখোশ পরে গণচেতনার সঙ্গে পরিষ্কার প্রতারণা। যেমন, আমরা দেখেছি বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট শাসনে বাংলাদেশের কবি লেখকদের বিরাট অংশ আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার কুৎসিত বাসনা নিয়ে শাসকদের নির্লজ্জ দালালি করতে, তোষামোদ করতে।
দেশের স্বাধীনতার জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য নজরুল তার জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন যে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি সম্ভার; যার আলো ও উত্তাপ যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের দেখাবে পথ, জোগাবে অনুপ্রেরণা। এ কথা গতকাল যেমন সঠিক ছিল আজও তাই আছে। আগামীকালও তাই থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা নজরুলচর্চা করব আমাদের আজকের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। হাঙরের কুমিরের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে নজরুলই আমাদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও উপাদান। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়; সব কালের সব ব্যথিত বঞ্চিত শোষিত মানুষের কাছে নজরুলই সবচেয়ে নির্ভুল বাতিঘর। আমাদের চেতনার অফুরন্ত উৎস।
আসলেই আমাদের জীবনে নজরুলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, অনিবার্য। নজরুল আমাদের জাতীয় শ্লাঘার প্রতীক, বাংলাদেশের অমিততেজা দুর্দম আত্মার ছায়াছবি। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংস্কৃতির রণাঙ্গনে সবচেয়ে বড় শৈল্পিক কণ্ঠ। আমাদের লড়াই, সংগ্রামে তার সৃষ্টিই আমাদের প্রধান অবলম্বন। এ কথার যথার্থতা দেখা গেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও নজরুলই ছিলেন আমাদের আত্মার মৌল উচ্চারণ। তীরহারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে দিতে আমরা গেয়েছি নজরুলের গান, তার কবিতা।
ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের তুঙ্গ মুহূর্ত জুলাই বিপ্লবেও নজরুল হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, অনিবার্য। সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। কারণ শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, গণআত্মাকে জাগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো বিকল্প নেই বাংলা সাহিত্যে। আমাদের সন্তানরা তাই তো নজরুলের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অকাতরে ঢেলে দিয়েছে বুকের রক্ত। সর্বশক্তি দিয়ে উৎখাত করেছে চরম কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী নিষ্ঠুর দুঃশাসনকে। রাজধানীসহ সারা দেশের দেওয়ালে দেওয়ালে যে গ্রাফিতি তারা এঁকেছে সেগুলোই সাক্ষী দেবে আমার কথার। অর্থাৎ পৃথিবীতে যতদিন অন্যায় থাকবে, দুঃশাসন থাকবে, শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে ততদিনই ততবারই নজরুল হয়ে উঠবেন বিপ্লবের আত্মার আত্মীয়।
তিন.
জীবনের জন্য যেমন দরকার আলো বাতাস খাদ্য ও পানি, বাংলাদেশের জন্যও সেই রকম প্রয়োজনীয় নজরুল। তিনি আমাদের সাহিত্যের অধিক সাহিত্য। জীবনের অধিক জীবন। কারণ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং নজরুল এক ও অবিভাজ্য সত্তা। এর বিভাজন হয় না।
ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার যত পানি আটকে রেখেছে, তার চেয়েও লক্ষ গুণ আবেগ ও ভালোবাসা বাংলাদেশের হৃদয়ে জমা আছে নজরুলের জন্য।
অনেক বড় বড় প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ইরানের জন্য যেমন ফেরদৌসী, ব্রিটিশদের জন্য যেমন শেক্সপিয়র, আমেরিকার জন্য যেমন হুইটম্যান, পাকিস্তানের জন্য যেমন ইকবাল, জার্মানির জন্য গ্যেটে, রাশিয়ার যেমন পুশকিন, তেমনি আমাদের জন্য নজরুল। এমনকি তাদের সবার চেয়ে বেশি। আমরা একটা আক্রান্ত ভূভাগে আছি। এ সংকটে জাতির বড় অবলম্বন তো তিনিই। এখানে সস্তা আবেগে ভেসে অন্যকিছু ভাবার সুযোগ নেই।
চার.
বাংলাদেশের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ছোট বড় জাতি, উপজাতি নির্বিশেষে দৈশিক ও বৈশ্বিক সব ক্ষেত্রে সব মানুষের জন্য সমান আতিথ্য নজরুল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমাদের জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সংগ্রামের তিনি সবচেয়ে প্রবল প্রতিনিধি, নায়ক। সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ গঠনের জন্য, মনোজগৎকে উদ্দীপ্ত ও সঞ্জীবিত রাখার জন্য নজরুলই তো উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেয়।
আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য সংগীত তথা জাতীয় সংস্কৃতির সব কিছু যে বিপুল সৌন্দর্য, ঔদার্য ও সামগ্রিকতা নিয়ে নজরুলে উদ্ভাসিত তার কি তুলনা হয়?
আবেগের সঙ্গে বেগ, প্রেম ও প্রকৃতির সঙ্গে বিপ্লব, বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞান, শ্রমজীবীর ঘামের সঙ্গে মরমিবাদ, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার যে জ্যোতির্ময় মিশ্রণ নজরুলে, তা আর কোথাও নেই।
পাঁচ.
নজরুলের শ্রেষ্ঠত্বের কিছু নতিজা
১. কবিতায় নজরুল যত ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন, অতো কাজ আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি।
২. একক কবিতা হিসাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’ সমতুল্য কবিতা বাংলাভাষা সাহিত্যে নেই। মাত্র ২৩ বছর বয়সে কবি লিখেছেন এই অবিস্মরণীয় কবিতাটি।
৩. বিষয় বৈচিত্র্যে, স্বাদে, গন্ধে, আঙ্গিকে, তাৎপর্যে তার বহুমুখীনতা তুলনাহীন।
৪. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পরাধীনতা, শোষণ, বঞ্চনাবিরোধী সংগ্রামে নজরুলের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এখানে তার ভূমিকা অগ্রনায়কের। আধুনিকতার নামে উপনিবেশিক ভূসিমাল খেয়ে আত্মহারা তিরিশের দশকের কেরানি কবিদের অবস্থান এক্ষেত্রে কোথায়?
৫. মানুষ, মানবতা, স্বাধীনতার জন্য নজরুলের চেয়ে বেশি কাব্য সফলতা বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
৬. নজরুল বাংলাভাষার গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত। তার আগে সাংবাদিকতা ছিল বিগত ফ্যাসিবাদী জামানার মতোই পদলেহী। তার ধূমকেতু ও লাঙলের মতো পত্রিকা আর কখনো প্রকাশ করা যায়নি। এ ধূমকেতুতেই ১৯২২ সালে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তিনিই প্রথম উপমহাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জেল-জুলুমসহ অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন। এটা সেই সময় যখন গান্ধী ও জিন্নাহ সাহেবরা পর্যন্ত স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করতে ভয়ে কাঁপতেন। সেসময় বাংলাভাষার অন্যান্য কবিদের কাউকেই কোথাও দেখা যায়নি।
৭. রবীন্দ্রনাথের নাম মাথায় রেখেই বলব নজরুল উপমহাদেশের সংগীতের সেরা প্রতিভা। তিনি আধুনিক বাংলা গানের জনক। পৃথিবীতে ছিল না, এ রকম ১৮টি নতুন রাগের তিনি স্রষ্টা। তা-ও মাত্র ১০ বছরে। আলাউদ্দিন খান, বেটোফেন কিংবা রবিশংকরের মতো মহৎ সংগীতজ্ঞরা যা পুরো জীবন ব্যয় করেও করতে পারেননি। অন্যদের গান যেখানে সাদা কালো টেলিভিশন নজরুলের গান সেখানে রঙিন টেলিভিশন। বিষয় বৈচিত্র্যে, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, কাব্যিকতাসহ যা বহুমাত্রিক। সংখ্যার কথা বাদ দিলাম। এইখানে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যদের কী কাজ? নজরুলের গান নিয়েও আমাদের ভূমিকা রক্ষণাত্মক। কিন্তু কেন?
৮. বাংলা গজল গানের জনক কাজী নজরুল।
৯. আধুনিক ইসলামি সংগীতের তিনি স্রষ্টা
১০. হীরালাল সেন ও নজরুল আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃত। নজরুল বাংলা ভাষার প্রথম কবি যিনি ক্যামেরা ছাড়া চলচ্চিত্রের সব শাখায় উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন। এক ডজনের বেশি সিনেমার তিনি কারিগর। এখানে প্রেমেন মিত্র, শৈলজা ছাড়া বাকিদের ভূমিকা শূন্য।
১১. নজরুল অপেরাধর্মী নাটকের পথিকৃত। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০টির মতো নাটক তিনি রেখে গেছেন। আমাদের নাট্যাঙ্গনের লোকজন কখনোই নজরুলের নাটকগুলো ছুঁয়েও দেখেনি। কারণ তাহলে তো আধিপত্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা জুটবে না।
১২. ঔপন্যাসিক নজরুল আজও অনাদৃতই রয়ে গেছেন। জানতে ইচ্ছা করে, মৃত্যুক্ষুধার মতো উপন্যাস বাংলাভাষায় আদৌ আছে কি?
১৩. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলাভাষার জনসম্পৃক্ততা ও সহজ স্বাভাবিকতার গতি রোধ করে, দেশের ৮০% মানুষের অধিকারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে, যে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করে বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল বিদ্রোহের নায়ক তো নজরুল। নজরুলের ভাষা বিদ্রোহের ওপর পর্যাপ্ত আলো ফেললেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। কিন্তু সে কাজগুলো করা হয়নি। কেন হয়নি? এখানে আবেগ নয় তথ্য উপাত্ত দিয়ে কথা বলতে হবে।
১৪. নজরুল শুধু কবি নন, শুধু সংগীতজ্ঞ নন, শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক পিতা নন, তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক। অন্য অনেককে বাদ দিয়ে হয়তো চলা যাবে কিন্তু নজরুলকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। এ কথা নেতাজি সুভাষচন্দ্র এবং পরে মওলানা ভাসানী বুঝেছিলেন সেই ১৯২৯ সালে, যখন নজরুলের বয়স মাত্র ৩০।
১৫. কারও সঙ্গে তুলনা করে কাউকে ছোট করা উচিত না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাথার উপরকার তারকাখচিত আকাশ। নজরুল আমার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সুখ-দুঃখের রক্তমাংসের মাটির পৃথিবী। মেহনতি মুক্তিকামী গণমানুষের আত্মা। জসীমউদ্দীন আমাদের নকশী কাঁথার মাঠ। জীবনানন্দ আমাদের রূপসী বাংলার নিঝুম নিসর্গ। আর নজরুল সকল বিবেচনায়ই আমাদের প্রাণের হাজার তারের বীণা।
