একবছর আগে কেউ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়ে জীবন দিয়েছেন। কেউ আবার দূর থেকে ছোঁড়া গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে পাশবিক নির্যাতনের পর হাসপাতালে মারা গেছেন। নির্বিচার হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে। অন্যদিকে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ক্ষমতায় থাকার সময় গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে এমন জীবন দেওয়া ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা উপস্থিত হয়েছিলেন রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ এই আলোচনা সভায় যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের কণ্ঠে ছিলো স্বজন হারানোর বেদনার কথা। হত্যার বিচার চেয়ে কেউ কেঁদেছেন, কেউ আবার গুম হওয়া সন্তান, স্বামী, পিতার অপেক্ষায় থাকার নিদারুণ কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। স্বজনদের এমন কান্না ছুঁয়ে গেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আমন্ত্রিত অন্যান্য অতিথিদেরও।
গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা পারভেজের কিশোরী মেয়ে রিধি বাবাকে কাছে না পাওয়ার কষ্টের কথা তুলে ধরে বক্তব্যে বলেন, ‘অনেক বছর আমি এবং আমার ছোট ভাই বাবাকে দেখতে পাই নি। আমি আর আমার ভাই বাবাকে কি কোনোদিন জড়িয়ে ধরতে পারবো না?’ এমন প্রশ্নে ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’য় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকা তারেক রহমানের চোখ ভিজে যায়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভিডিও বার্তায় বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে উদ্বোধন করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও শীর্ষ নেতারা। এছাড়া অনুষ্ঠানে জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গুম, খুন ও নিপীড়নের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপরই ফ্যাসিবাদী শাসনের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতি এবং গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের গল্প উঠে আসে মঞ্চে।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া অনেকের পরিবারের সদস্যরা এবং আহতরা অভিযোগ করে জানান, আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ পেলেও তাদের পরিবারের পাশে অথবা তাদের চিকিৎসায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমন্বয়কদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এসময় শহীদদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কেউ আবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদের উচ্চকক্ষ (প্রস্তাবিত) ও নিম্নকক্ষে নিজেদের প্রতিনিধিত্বও চেয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে সাভারে শহীদ হওয়া ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন বলেন, শান্তির স্বার্থে শুধু সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে হওয়া উচিত।
একইসঙ্গে আগামী নির্বাচনে শহীদ পরিবার (জুলাই গণঅভ্যুত্থান) থেকে সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ১০ জন প্রতিনিধি মনোনয়নের আশা করেন বলে জানান তিনি।
গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ও ‘মায়ের ডাক’র আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, আমাদের অনেক বাধা অতিক্রম করে আজকে এখানে আসতে হয়েছে। বিগত সময়ে যত গুম-খুন হয়েছে, জুলাইয়ে আমাদের ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর সবার আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা এখানে এসেছি।
তিনি আরও বলেন, ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি, গুমের মহাকৌশলে যারা যুক্ত ছিলেন, যাদের মদদে আয়নাঘরে আমাদের ভাইদের ধরে নেওয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে; তাদের প্রত্যেকের জন্য আমরা বিচার চাই। যতদিন আমাদের শরীরে রক্ত আছে, আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়বো।
আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাতে নিহত বিশ্বজিৎ দাসের বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে, এর বিচার এখনও হয়নি।
বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে নিহত শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা বলেন, আমার ছেলের হত্যার বিচার আমি এখনও পাইনি। কী অপরাধ ছিল আবরার ফাহাদের? সে দেশের পক্ষে কথা বলায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে। নতুনভাবে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে, এই স্বাধীনতা যেন অব্যাহত থাকে।
জুলাই আন্দোলনে ঢাকায় প্রথম শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বোন বলেন, আমার ভাই ২৮ জুলাই শহীদ হয়। সে ছিল ঢাকার প্রথম শহীদ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমরা যে বিজয় এনেছি, তা আমরা ধরে রাখতে পারছি কি না, তা প্রশ্ন থেকে যায়।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, জুলাইয়ে দল-মত নির্বিশেষে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু এক বছর পর আমার মনে হয় সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারছি না। এই বিপ্লবের ফলে আমাদের আশা ছিল নতুন কিছু দেখতে পাব। স্বৈরাচার হাসিনা যত অপকর্ম করেছে, এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা দেখতে চাই।
গণঅভ্যুত্থানে প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই বলেন, আবু সাঈদ বুক পেতে দেশের সবার সাহস জুগিয়েছিল, তাই ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে।
তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে শহীদ পরিবারের পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
