রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে এবং একটি স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ( প্রস্তাবিত ) নামে নতুন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শিক্ষার্থীদের রয়েছে অগণিত স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। তবে অধিভুক্তির পর থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল নানা জটিলতা। পরীক্ষার সময়সূচি, ফল প্রকাশে বিলম্ব, স্বতন্ত্র পরিচয়ের সংকটসহ নানা দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করে আসছিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্তির আট বছর পেরিয়ে গেলেও এসব সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি; বরং পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি কলেজেই শিক্ষাবিষয়ক নানান সংকট প্রকট হয়ে উঠলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সে দিকে ছিলনা নজর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে শিক্ষার মান ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং ঢাবি অধিভুক্ত বাতিল করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ৫ আগস্টের পরে আন্দোলনে নেমেছিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ (প্রস্তাবিত) নামে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করে। নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শিক্ষার্থীদের মনে জন্ম নিয়েছে অগণিত স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
কবি নজরুল কলেজের ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী বলেন , বিগত সময়ে সাতকলেজের শিক্ষার্থীদেরকে নির্মম শিক্ষাজীবন থেকে উদ্ধার করার লক্ষ্য হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি সেই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমি বিশ্বাস করি,দীর্ঘদিনের জটিলতা শেষে শিক্ষার্থীদেরকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল টি যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে,তাতে করে কলেজগুলোর ঐতিহ্য বজায় থাকবে।
তিনি আরও বলেন , কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পড়াশোনায় বৈষম্যের স্বীকার ছিল তা কিন্তু নয়,তারা সহশিক্ষা কার্যক্রমেও অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল।রাষ্ট্রের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই চলমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সহ সকলের শিক্ষাজীবনে আমূল-পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা করি।আমি বিশ্বাস করি দেশের অর্থনীতি,রাজনীতি সহ সকল সেক্টরে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কবি নজরুল কলেজের গণিত বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান মারুফ বলেন, ২০১৭ সালে সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর আমরা উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের আশা করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা কাঙ্ক্ষিত সেবা ও সুবিধাগুলো পাইনি। আমাদের ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা , যার ফলে শিক্ষার্থীদের সময় ও ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি, ফলে পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে। অধিভুক্তির নামে দায়িত্বের ভার ছিল, কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচয় বা গুরুত্ব ছিল না। ফলে আমরা পরিচয় সংকট এ ভুগেছি।
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ঘিরে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠিত হওয়ায় আমরা নতুন আশায় বুক বাঁধছি। এখন একটি কার্যকর ও স্বতন্ত্র প্রশাসন, যারা সাত কলেজের বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে। নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা ও দ্রুত ফলাফল প্রকাশ করবে। একটি আধুনিক, ডিজিটাল, এবং শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিক্ষা পরিবেশ তৈরি হবে যা বর্তমান শিক্ষার্থীদের পরিচয় ও মর্যাদাকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করা। আমরা চাই, এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় টি যেন কাগজে-কলমে না থেকে বাস্তব জীবনে আমাদের শিক্ষাজীবনকে গতি ও গৌরব এনে দেয়।
কবি নজরুল কলেজের একই বিভাগের শিক্ষার্থী ইউশাহ বিন আলম বলেন, ঢাবি অধিভুক্ত থাকাকালীন সময়ে ভোগান্তির শেষ ছিলো না। গণিত বিভাগের মতো একটি টেকনিক্যাল বিষয়ের অনার্স ও মাস্টার্স মিলিয়ে যেখানে প্রায় ৭০০ এর বেশি শিক্ষার্থী, সেখানে শিক্ষক ছিলো মাত্র ৪ জন। ১ম ও ২য় বর্ষে কিছু ‘নামমাত্র ক্লাস’ পেয়েছি কিন্তু ৩য় বর্ষে এসে সেইটুকুও হারিয়ে যায়। ল্যাব ক্লাস ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে তড়িঘড়ি করে চালানো হয়। ল্যাব ক্লাসের জন্য পর্যাপ্ত কম্পিউটারও ছিলো না আর সেশনজট ও রেজাল্টজট তো আমাদের একাডেমিক জীবনের নিত্যদিনের যন্ত্রণা। ৬/৭ মাস অপেক্ষা করে ফলাফল পেতাম, তাও গণহারে একটি বিষয়ে প্রায় সকলকেই ফেল করানো হতো।
তিনি আরও বলেন ,আমার গবেষণার আগ্রহ, অনার্স থেকেই চাইতাম গবেষণা শুরু করতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখানে সে সুযোগ নেই। শিক্ষকরা মূলত বিসিএস কেন্দ্রিক, গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার পরিবেশ অনুপস্থিত। এই সকল অভিজ্ঞতা থেকেই আমার প্রত্যাশা—প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ আমাদের এই স্থবির বাস্তবতা থেকে মুক্তি দেবে। পর্যাপ্ত শিক্ষক, মানসম্মত ক্লাস ও ল্যাব, সুশৃঙ্খল একাডেমিক ক্যালেন্ডার, গবেষণার সুযোগ, সময়মতো রেজাল্ট, ভালো সিজিপিএ অর্জনের পরিবেশ থাকবে। উচ্চশিক্ষার এই সুশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্যে আমি সহ সকলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়ে, ভালো ফলাফল করে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি, এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়-ই আমাদের বাস্তবিক অর্থে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
