ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক মহা তীর্থস্থান পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার। ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে এই এলাকা শাঁখা-শঙ্খ বিক্রির জন্য বিখ্যাত। পরম্পরায় এখানে অসংখ্য শাঁখারীর বসবাস। ভালো মানের শাঁখার খোঁজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শাঁখা কিনতে শাঁখারীবাজারে ছুটে আসেন অগণিত মানুষ। দুর্গোৎসব উপলক্ষে এখানে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ভিড় অনেক বেড়ে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, শাঁখারীবাজারের শাঁখা, সিঁদুর ও শঙ্খের দোকানগুলোতে প্রচুর ভিড় করছেন ক্রেতারা। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব ক্রেতাদের আগমন। বাহারি ডিজাইনের শাঁখার খোঁজে ক্রেতারা এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছেন। তিনশত টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ -ছয় হাজার টাকা জোড়া দামের শাঁখাও কিনছেন অনেকে। শঙ্খ বিক্রি হচ্ছে দুইশত টাকা থেকে পাঁচশত টাকার মধ্যেই।
শাঁখারীবাজারের বিক্রেতারা জানান, একসময় প্রাচীন পদ্ধতিতে এখানকার বেশিরভাগ দোকানে নিপুণ হাতে শাঁখা তৈরি হতো। তবে এখন আগের সেই সময় নেই। হাতে তৈরি শাঁখার কদর কমেছে। এখন মেশিনে তৈরি হয় বাহারি ডিজাইনের শাঁখা। যদিও মেশিনের চেয়ে হাতে বানানো শাঁখার মান ভালো। কিন্তু মেশিনে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন খুব সহজেই করা যায়। হাতে সেই সুযোগ কম। তাই মানুষ এখন টেকসই না খুঁজে বিচিত্র ডিজাইন খোঁজ করেন।
শাঁখারীবাজারে ‘মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়ে’ শাঁখা কিনতে আসা সীমা রানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখানে আমার দিদির বাসা। আমি গাজীপুর থেকে এখানে এসেছি শাঁখা কিনতে। একজোড়া শাঁখা কিনেছি ১২০০ টাকা দিয়ে। আরেক জোড়া কিনবো ডিজাইন ভালো দেখে, তবে দাম বেশি বলছে। গত বছরের তুলনায় এবার সুন্দর ডিজাইনের শাঁখার দাম একটু বেশি। আসলে ভালো মানের শঙ্খ দিয়ে তৈরি শাঁখা কিনতে গেলে একটু বেশি দাম দিতে হয়।
পূজা উপলক্ষে নতুন শাঁখা কিনতে আসা অনুশ্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এবার পূজার অনেক দিন আগেই শাঁখা কিনতে চলে এসেছি। কারণ, পূজা যত ঘনিয়ে আসবে, শাঁখার দাম তত বেড়ে যাবে। আমার এমনিতে কয়েক জোড়া শাঁখা আছে। তবু অষ্টমীতে নতুন শাঁখা পরবো বলে আগেভাগে কিনে নিচ্ছি। পূজা আসবে, আর নতুন শাঁখা নেবো না—এটা হয় না। আমি নিজের জন্য দুই জোড়া, আর মা এবং ভাইয়ের বউয়ের জন্য দুই জোড়া শাঁখা কিনেছি।
শাঁখা শঙ্খ বিক্রির বিষয়ে ‘শঙ্খশ্রী’ দোকানের মালিক রিপন দত্ত (৪৫) বলেন, শাঁখা বিক্রি কমবেশি সবসময় হয়। তবে দুর্গাপূজার সময় একটু বেশি হয়। এই সময় সবাই দুই-তিন জোড়া করে শাঁখা কেনেন। প্রতি জোড়া ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা দামের শাঁখাও আমরা বিক্রি করি। তার সঙ্গে শঙ্খের চাহিদাও আছে। এখন তো তুলনামূলক কাস্টমার কম। পুজোর দু-তিন দিন আগে আরও বেশি বেচাকেনা হবে।
রিপন দত্ত আরও বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা উপলক্ষে শাঁখারীবাজার থেকে শাখা নিতে আসেন। কারণ শাঁখারীবাজারে যে মানের শাঁখা পাওয়া যায়, তা বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখান থেকেই ব্যবসায়ীরা শাঁখা নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করেন। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই দৃশ্য দেখে এসেছি। আমাদের বাপ-দাদাদের হাত ধরেই এই অঞ্চলে শাঁখা-শঙ্খ বিক্রির প্রচলন।
শাঁখা-শঙ্খের আমদানি সম্পর্কে শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ী মধুসূদন নন্দি (৫৬) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটা সময় ছিল শাঁখারী বাজারের বেশির শাঁখা-শঙ্খ আসতো শ্রীলঙ্কা থেকে। সেখান থেকে আমরা কাঁচামাল এনে বাংলাদেশে শাঁখা তৈরি করতাম। তখন তুলনামূলক খরচ কম পড়তো। এরপর বন্যা, করোনাসহ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি খারাপ দেখে কাঁচামাল আনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ভারত থেকে সরাসরি তৈরি করা শাঁখা আমদানি করি। এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার তুলনায় তুলনামূলক খরচ একটু বেশি হয়।
তিনি আরও বলেন, শাঁখা-শঙ্খের চাহিদা কেবল দুর্গাপূজা এলে হয়, বিষয়টা এমন না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এর চাহিদা সারা বছর থাকে। সরকারি উদ্যোগে যদি শাঁখা-শঙ্খের কাঁচামাল আমদানি করা যেতো, বা এক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি দিতো—তাহলে দামে আরও সস্তা পাওয়া যেতো। তাছাড়া এখনকার শাঁখারীদের অবস্থাও নাজুক। শাঁখারীদের কাজে লাগিয়ে এই ব্যবসা একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে নেওয়া যায়।
হাতে তৈরি শাঁখার ঐতিহ্যের বিষয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন হাতে তৈরি শাঁখা তেমন হয় না বললেই চলে। হাতে একজোড়া শাঁখা তৈরি করতে যে সময় ব্যয় হয়, মেশিনে ওই সময়ে ১০ জোড়া শাঁখা বানানো যায়। তাছাড়া হাতে মেশিনের মতো বাহারি ডিজাইন করা যায় না। মজুরি কম হওয়ায় এখন কেউ শাঁখা তৈরির কারিগরও হতে চান না। তবে অনেকে এখনও হাতে তৈরি শাঁখা পরেন। সেক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দ মতো ডিজাইন দিয়ে যান। আমরা সে অনুযায়ী শাঁখা তৈরি করে দেই।
ছবি: বাইজীদ সা’দ


















