রাস্তার পাশে এখনো চোখে পড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা ডাকবাক্স। কোনোটি হয়তো বেঁকে গেছে, নয়তো জং ধরেছে। কোথাও আবার রং করে যত্নে রাখা আছে শো-পিসের মতো। অনেকে এগুলোর পাশে বসে ছবি তোলেন। তারপর উদাস ক্যাপশন লিখে আপলোড করেন ফেসবুকে। কেন? ডাকবাক্সের সঙ্গে ছবি তোলার এ প্রবণতা কি আমাদের এক ধরনের স্মৃতিকাতরতা? নাকি শুধুই একটি অ্যাস্থেটিক ট্রেন্ড?
এক সময় চিঠি পাঠানোর নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল ডাক। দূরের প্রিয়জনের কাছে কিংবা প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক চিঠি পৌঁছে দিতে এই লাল ধাতব বাক্সে ফেলা হতো। চিঠি লেখা, খামে ভরে তাতে ঠিকানা লেখা, তারপর হেঁটে গিয়ে ডাকবাক্সে ফেলা, পুরো প্রক্রিয়াটিতে ছিল এক ধরনের আবেগ ও অপেক্ষার রোমাঞ্চ।
সময় বদলেছে। প্রযুক্তির ঝড়ে উড়ে গেছে সেসব দিন। বদলে গেছে যোগাযোগের ধরন। এখন মুহূর্তেই মেসেজ চলে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার দিনগুলো এখন অতীতের গল্প। তবুও আজ যখন কোনো পুরোনো পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের একটি ডাকবাক্স চোখে পড়ে, তখন যেন অনেকের মনে পড়ে যায় সেই অপেক্ষার দিনগুলো, যখন চিঠি মানেই ছিল খামভর্তি আবেগ।
ডাকবাক্সগুলো এখনো পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়নি। এখনো অনেক দাপ্তরিক চিঠি, মামলা ও তালাকের চিঠি প্রায়ই ডাকযোগে পাঠানো হয়। তবে এই লাল ডাকবাক্স বেশি ব্যবহার হয় ছবি তোলার এক অ্যাস্থেটিক স্পট হিসেবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এখন প্রতিটি মুহূর্তই যেন ক্যামেরাবন্দি হওয়ার অপেক্ষায়। তরুণ-তরুণীরা সেলফি বা ফটোশুটে নতুন নতুন ব্যাকড্রপ খুঁজে বেড়ান। আর সেই ব্যাকড্রপ হিসেবে পুরোনো ধাঁচের ডাকবাক্স এখন হয়ে উঠেছে একেবারে ট্রেন্ডি উপকরণ।
শহরের পুরোনো পোস্ট অফিস, কলেজ ক্যাম্পাসের এক কোণে ধুলোমাখা ডাকবাক্স কিংবা গ্রামীণ এলাকার কোনো নিরিবিলি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাক্স —সব জায়গায়ই এখন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠে। কেউ স্টাইলিশ পোশাক পরে দাঁড়িয়ে তুলছেন পোর্ট্রেট, কেউ বা হঠাৎ করেই একগাল হাসিতে ভরা সেলফি তুলে নিচ্ছেন। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে চোখ রাখলেই দেখা যায় ডাকবক্স সম্পর্কিত হ্যাশটাগ করা নানা রকম পোস্ট ছড়িয়ে আছে।
এই ট্রেন্ড শুধু ছবি তোলা নয়, অনেকের কাছে এটা এক ধরনের নস্টালজিক কানেকশন। কারণ, ডাকবাক্সের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের মা-বাবার শৈশবের স্মৃতি, পারিবারিক সম্পর্কের গল্প, প্রেমপত্রের আবেগ, কিংবা প্রবাসে থাকা প্রিয়জনের খোঁজ পাওয়ার আনন্দ। কারো কারো কাছে ডাকবাক্স মানেই বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়ে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার স্মৃতি, কারো কাছে প্রথম প্রেমের গল্প। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলা মানে যেন সময়কে একবার ছুঁয়ে দেখা।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ট্রেন্ডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। রেট্রো বা ভিন্টেজ ধাঁচের ফটোশুট এখন বেশ জনপ্রিয়। অনেকে মুডবোর্ড বানিয়ে শুটিংয়ের জন্য বেছে নিচ্ছেন পুরনো পোস্ট অফিসের আশপাশের এলাকা। লাল ধাতব বাক্স, পুরনো দেয়াল, হালকা বিকেলের রোদ সবকিছু মিলে তৈরি হচ্ছে দারুণ সিনেমাটিক দৃশ্য। কেউ কেউ হাতে খাম বা ডাকটিকিট নিয়ে পোজ দেন, যেন সত্যিই কোনো চিঠি ফেলতে এসেছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ট্রেন্ড বেশ পরিচিত। ঢাকার সংসদ ভবন এলাকায় থাকা পুরনো ডাকবাক্সের পাশে এখনও দেখা যায় তরুণ-তরুণীর ছোট ছোট ফটোসেশনের আয়োজন। পুরান ঢাকার কিছু এলাকাতেও এখনো কিছু ডাকবাক্স টিকে আছে, যা ফটোগ্রাফারদের কাছে দারুণ আকর্ষণের জায়গা হয়ে উঠেছে। এমনকি গ্রামের পোস্ট অফিসগুলোর সামনেও এখন স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা বিশেষ দিনে বা ভ্রমণের সময় ছবি তুলতে ভিড় করেন। কেন? তাদের একজন শাম্মী আখতার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা তো পুরোনো দিনের জিনিস। অনেকটা মায়ের শাড়ির মতো। তাই শখ করে ছবি তুলছি।’
আজ ৯ অক্টোবর, জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব ডাক দিবস। এই দিনে বলা যায় ডাকবাক্সের সঙ্গে ছবি তোলার ট্রেন্ড আসলে শুধু একটা ফ্যাশন নয়; এটা অতীত ও বর্তমানের এক মিষ্টি সংযোগ। ডিজিটাল যুগের ব্যস্ততায় আমরা হয়তো চিঠি লেখা ভুলে গেছি, কিন্তু প্রবীনদের স্মৃতিগুলো এখনো রঙ হারায়নি। আর সেই স্মৃতির লাল রঙ আজ আবার নতুন করে ধরা দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ছবিতে, তরুণদের হাসিতে, আর ক্যামেরার ক্লিকের শব্দে।
















