আজ মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি)। সাকরাইন উৎসব। পুরান ঢাকার আকাশে শোভা পাবে নানা রঙ আর বাহারি ঘুড়ি। ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবের চিত্র এমনটাই থাকে পুরান ঢাকায়। একে ঘুড়ি উৎসব বা পৌষ সংক্রান্তিও বলে।
ঐতিহ্যের আলোয় পৌষের শেষদিনকে রঙিন করতে মাতোয়ারা পুরান ঢাকাবাসী। তাই উৎসব ঘিরে পুরান ঢাকার অলিগলিতে চলছে ঘুড়ি বেচাকেনার উৎসব। শিশু, তরুণ, বৃদ্ধরা কিনছেন ঘুড়ি, নাটাই, সুতা। চলছে সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার কাজ। পুরান ঢাকায় চলছে ঘুড়ি বেচাকেনার ধুম।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দোকানে দোকানে হরেকরকমের ঘুড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রঙ-বেরঙের ঘুড়ি আর নাটাই-সুতা সারি সারি করে সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। বাজারে বিভিন্ন নামের ঘুড়ি পাওয়া যাচ্ছে।
সেগুলোর মধ্যে অন্যতম- চোখদার, চশমাদার, কাউটাদার, লাভবার্ড, পঙ্খিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, ঈগল, সাদাঘুড়ি, চার বোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভঘুড়ি, তিন টেক্কা, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুড়, চিল, অ্যাংগ্রি বার্ডস হরেক রঙের ঘুড়ি।
এসব নাটাই মিলবে ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। সেসব সুতার মধ্যে রক সুতা, ডাবল ড্রাগন, কিংকোবরা, ক্লাক ডেবিল, ব্লাক গান, ডাবল গান, সম্রাট, ডাবল ব্লেট, মানজা, বর্ধমান, লালগান ও টাইগার অন্যতম।
সাকরাইনকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার বিশেষত শাঁখারিবাজার, লক্ষ্মীবাজার, গেন্ডারিয়া,সূত্রাপুর, রায় সাহেব বাজার, তাঁতীবাজার, গেণ্ডারিয়া ও সূত্রাপুর এলাকায় সুতা,নাটাই ও ঘুড়ি বিক্রির ধুম পড়েছে।
পুরান ঢাকার ঘুড়ি বেচাকেনার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারী বাজারের এক ব্যবসায়ী নিতাই বাবু বলেন গত বছরের তুলনায় এবছর ঘুড়ি বেচাকেনা কম হচ্ছে। তবুও আগামীকাল অবধি আমার দোকানের ঘুড়ি না থাকার সম্ভবনা বেশি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা দিনের বেলা কম আসলেও বিকেলের পরে বেচাকেনা বেড়ে যায়। দিনের বেলা দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসে।
শাঁখারী বাজারে ঘুড়ি কিনতে আসা কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম বলেন, আমার বাসা নদীর ওপার কেরানীগঞ্জে, তবে প্রতিবছর পুরান ঢাকার বন্ধুদের বাসার ছাদে এই উৎসবটি অংশ গ্রহণ করে থাকি। তাই এ বছর ১১ টা ঘুড়ি কিনলাম নিজের ও পাশাপাশি বন্ধুদের জন্য।
কলতাবাজারের বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, গতবছর শেষের দিকে ভালো মানের ঘুড়ি পাই নি তাই এ বছর আগে থেকেই ৩০টা ঘুড়ি কিনেছি। সাকরাইন উৎসব মানেই হলো ঘুড়ি উড়ানো, অন্যের ঘুড়ি কেটে আনন্দ পাওয়া। বছরে এই একটা দিনই আমরা ঘুড়ি উড়াতে পারি। এসময় অন্যেরটা ঘুড়ি ও কাটি নিজের ঘুড়িটাও কাটা পরে।
ভিক্টোরিয়া পার্কে কয়েকজন স্কুল ড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের হাতে ঘুড়ি, নাটাই ও সুতা নিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর সরাসরি প্রস্তুতি দেখলাম। তারা জানান আগামীকাল ঘুড়ি উৎসব তাই আজ থেকেই প্রাকটিস চলছে। কালকে আমাদের বাসার ছাদের উপরে যেই ঘুড়িটা আসুক আমার টার্গেট থাকবে ওটাকে কেটে নিজের করে নেওয়া। গতবছর বেশকিছু ঘুড়ি কেটেছি এইবারও এমনই হবে। যদিও আমার ও কিছু ঘুড়ি কাটা পড়েছিল।তাই এ বছর পর্যাপ্ত কিনেছি।
পুরান ঢাকার মালিটোলা পার্কটি খোলা আকাশের নিচে ওখানে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া হাসান নামের এক শিক্ষার্থীকে ঘুড়ি উড়াতে দেখি। তিনি বলেন, অন্যের ঘুড়ি কেটে ফেলবো এটা ভাবতেই ভালো লাগে। আমরা সেই ছোট বেলা থেকে এই উৎসবটি পালন করে আসছি। পুরান ঢাকার এটি ঐতিহ্য।
সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার পুরান ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে থাকবে জাড় বাতি, লাইটিং সাউন্ড বক্স ফানুস উড়ানো।বিকেল বেলা চলবে ঘুড়ি কাটাকাটি। ওদিন পুরান ঢাকার আকাশে দেখা যাবে বাহারি রঙের ঘুড়ির সমারোহ।
ধোলাইখালের বাসিন্দা আব্দুল ময়না মিয়া বলেন, সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যার পরে ডিজে পার্টি, নাচ গান এটি উৎসবের নামে অপসংস্কৃতি। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় বসবাস। তখন এগুলো ছিল না ইদানীং এসব সংস্কৃতি হয়ে যাচ্ছে। কি করবো মেনে নিতে হচ্ছে, সয়ে গেছে। তবে বিকেলের ঘুড়ি উড়ানোটা উপভোগ করি।সেই শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, সাকরাইনের দিন রাতে পুরান ঢাকায় খুব বাজে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আতশবাজি, ফানুস ও সাউন্ড বক্সের শব্দে আমাদের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়ে থাকে। ঘুমেও আমাদের বিরক্ত হয়। অসুস্থ,বৃদ্ধ রোগীদের অনেক কষ্ট হয়।তাই এসব কাজ আরেকটু সহনশীল হয়ে করলে সবার জন্য উপকার।
লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা রহিমন বিবি বলেন, আমাদের বাসায় এদিন আমরা পিঠা উৎসবের আয়োজন করি। ছেলে মেয়েদের বন্ধুরাসহ আমাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন আসে সাকরাইন উৎসবক উপভোগ করতে।তাই এদিন একটু হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ফিরে পায়।পিঠা উৎসবেরও আয়োজন হয়ে থাকে বাসায়।
