ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপত্য রূপলাল হাউজ—যা একসময় বুড়িগঙ্গার তীরে ইউরোপীয় রেনেসাঁ শৈলীর অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল—আজ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতলে। পুরান ঢাকার ফরাসগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত এই দুইতলা প্রাসাদটি এখন পিয়াজ মসলার আড়ত, গুদাম এবং পাইকারি দোকানে পরিণত হওয়ায় এর স্থাপত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চরম অবহেলার মধ্যে পড়ে রয়েছে।
গৌরব থেকে গ্লানিতে রূপলাল দাস ও তাঁর ভাই রঘুনাথ দাস ১৮৪০–এর দশকে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ঢাকার আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে তারা নতুন করে প্রাসাদটির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। মার্টিন অ্যান্ড কোং–এর স্থপতির নকশায় তৈরি E–আকৃতির এই প্রাসাদে ছিল ৫০টিরও বেশি কক্ষ, বারান্দা জুড়ে সেমি–কোরিন্থীয় স্তম্ভ, আর দ্বিতীয় তলায় মনোমুগ্ধকর কাঠের মেঝের নাচঘর।
১৮৮৮ সালে ঢাকায় সফরকালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের সম্মানে এই ভবনে জমকালো বল–ড্যান্সের আয়োজন করা হয়েছিল—যা তৎকালীন অভিজাত সমাজের মিলনমেলা হিসেবে জায়গা করে নেয়।
কিন্তু, ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভবনের চূড়ার ঐতিহাসিক ঘড়িটি ভেঙে পড়ে আর আর কখনো ঠিক হয়নি।
সরেজমিন দেখা যায়, শত বছরের পুরোনো এই ঐতিহাসিক স্থাপনার বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে মসলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পেয়াজ, রসুন, মরিচ, জিরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শুকনো মসলার বস্তায় এখন ভরপুর রূপলাল হাউজের নিচতলা।

গুদাম ও ট্রাকে পণ্য ওঠানামার ভিড়ে ভবনের নকশা, কারুকাজ, অলংকরণ ধুলো–বালিতে হারিয়ে যাচ্ছে। কোথাও প্লাস্টার ঝরে পড়ে ইট বেরিয়ে এসেছে, কোথাও ভেঙে গেছে দোতলার সিঁড়ি।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, রূপলাল হাউজ এখন ইতিহাস নয়, ব্যবসার জায়গা; বছরের পর বছর কেউ এর দিকে তাকায়নি।
মিরপুর থেকে দেখতে আসা জোনায়েদ জানান, আমি ছবি দেখে এসেছি, কিন্তু বাস্তবে এসে মনে হচ্ছে—ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। নিচতলা পুরোটায় মসলার আড়ত, উপরে যেতে দেওয়া হয় না।
নিচতলায় আড়তে কাজ করা শাহিন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, এখানে প্রায় ৮ বছর ধরে কাজ করি। ভবনটা নাকি ১০০ বছরের সরকারি লিজে দেওয়া। উপরের অংশে সেনাবাহিনীর কিছু পরিবার থাকে, তাই ওই অংশ সাধারণ মানুষ দেখার সুযোগ পায় না।
এই জটিল মালিকানা, দখল, অবৈধ ব্যবহার এবং প্রবেশ নিষেধের কারণে পর্যটন বা সংরক্ষণ—দুটোই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, রূপলাল হাউজ তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হলেও দীর্ঘদিন কার্যকর সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।
কারণ— দখলদারি ও লিজসংক্রান্ত আইনি জটিলতা, স্থাপনার ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো, অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যবহার, সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের সংকট
পুরান ঢাকা সংরক্ষণ আন্দোলনের কর্মীরা বলেন, রূপলাল হাউজ শুধু একটি ভবন নয়, এটি ঢাকার ইতিহাসের প্রতীক। এখনই সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে স্থাপনাটি একদিন পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে।
বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদ—যেখানে ছিল সঙ্গীত, নৃত্য, অতিথিশালা ও অভিজাত সমাবেশের জয়জয়কার—আজ নিঃশব্দে ভেঙে পড়ছে মসলার বস্তা, ধুলো ও দখলের চাপে।
একসময় ঢাকার ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল রূপলাল হাউজ; আজ তা ইতিহাসের নির্জন সাক্ষী হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের ধুলোয়।




















