বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা গোলাম সরোয়ার টুকু কপর্দকহীন থেকে গত এক যুগে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে নিয়ে আলোচনা অনেক। তিনি ভাগিয়ে নিয়েছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ, এমনকি ডামি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হয়েছিলেন এমপিও।
তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে কিছুই ছিল না তার। বউ নিয়ে থাকতেন শ্বশুরবাড়িতে, চলতেনও শ্বশুরের অর্থে। তবে ৮ম জাতীয় সংসদ নিবার্চনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা এবং দালালিই হয়ে ওঠে তার মূল পেশা। আর এভাবে কপর্দকহীন এক ব্যক্তি, আওয়ামী লীগের পরিচয়কে পুঁজি করে কয়েক বছরের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন। নিজের টিনশেড খুপড়ির বাড়ি ভেঙে বরগুনা শহরের ফার্মেসী পট্টিতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছেন বহুতল সুরম্য অট্টালিকা। পরবর্তীতে সেই অট্টালিকাকে রূপান্তরিত করেছেন বৃহৎ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
বরগুনা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ফারজানা সুমিকে এলাকায় কোনঠাসা করে রাখা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেল দিয়ে ঘায়েল, জোরপূর্বক জমি দখল, টাকার জন্য গরীব রিকশাচালকের রিকশা আটকে রাখা, নিয়োগ বাণিজ্য, মাত্র সাত মাসেই ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে টিআর-কাবিখার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ আর মাদক সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতাসহ এন্তার অভিযোগ তার নামে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এমপি হওয়ার পর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জমি দখল এবং বরগুনা সংসদীয় আসনের ঠিকাদারির কাজ পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মাত্র সাত মাসেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। যে জমিই পছন্দ হতো, নামমাত্র দামে নিয়ে নিতেন এমপি টুকু। এর মধ্য জমিসহ কবরস্থান দখল করেছেন বরগুনার প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডাক্তার মনিজার। এমপি টুকুর কাছে কোন জমির মালিক জমি বিক্রি করতে না চাইলে ভয় দেখিয়ে দখল করে নেওয়া হতো। এ কাজে তাঁদের যেমন সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল, তেমনি পুলিশ বাহিনীকেও কাজে লাগাতেন। এভাবে এমপি হওয়ার মাত্র সাত মাসেই বরগুনা, আমতলী আর তালতলীতে ৪৫০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন তিনি।
এছাড়া নামে বেনামে অগণিত ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি করেছেন ঢাকা এবং বরিশালে। পরিচয় গোপন করে পর্যটন শহর কুয়াকাটায় করেছেন ফোর স্টার মানের বিলাসবহুল হোটেল। গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেটের বিজনেস। তার দ্বিতীয় জলসাঘর বরিশাল নগরীতে। সেখানে কয়েক একর জমি দখল করে ব্যবসাকেন্দ্র করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সহযোগিতায়। তাছাড়া, মালয়েশিয়ায় শত কোটি টাকা পাচার করে রিয়েল এস্টেট ও আবাসন ব্যবসায় লগ্নি করেছেন বলে জানা যায়। তবে তার এই অথের্র সবই অপ্রদর্শিত।
টুকুর ক্ষমতার দাপট এতটাই ছিল যে বিরোধী দলের পাশাপাশি রেহাই পাননি নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও। দলের বাইরে তিনি গড়ে তুলেছিলেন আরেক দল। সেই দলের নাম ছিল ‘টুকু লীগ’। তার এই অস্ত্রধারী বাহিনীর হাতে বরগুনার রাজপথে নিজ দল আওয়ামী লীগসহ বিএনপি-জামায়াতের অজস্র নেতাকর্মী হেনস্থর শিকার হন। এমনকি পান থেকে চুন খসলেই এলাকার নিরপরাধ মানুষকে ছাড় দেয়নি তার এই বাহিনী। এই হেনস্থার শিকার রাজনীতিবিদদের ভেতরে ছিলেন বরগুনার অন্যতম জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান শিহাব। ২০১৮ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জনসভা চলাকালীন সময়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে টুকু শিহাবকে প্রকাশ্যে চর-লাথি মারার পাশাপাশি তার জীবননাশের হুমকিও দেন। এমনকি ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে বরগুনার মহিলা এমপি ফারজানা সুমির আপন খালাতো ভাই এবং বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুম্মান আহমেদ লিসানকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন বরগুনা-১ আসনের তৎকালীন এমপি টুকু। যা ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে জুম্মান আহমেদ লিসান বলেন, কোন কারণ ছাড়াই সাবেক এমপি টুকু আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন। ওনার সেই হুমকির পর আমার পরিবার আমাকে বরগুনার বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
এমপি টুকু এতই ক্ষমতালোভী আর জঘন্য ছিলেন যে, সামান্য কিছু টাকার জন্য গরীব রিকশা চালকের রিকশাও আটকে রাখার নজির স্থাপন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানা যায়, লকডাউনের সময় বরগুনার নাথপট্টি লেকের মোড়ে রিকশা চালক খলিলের রিকশার সামনে একটি মাইক্রোবাস হঠাৎ করেই ব্রেক করে বসে। ফলে চলন্ত রিকশাটি গিয়ে লাগে সেই মাইক্রোবাসের পেছনের দিকে। বেশ খানিকটা দাগ পড়ে যায় মাইক্রোবাসে। ওই অপরাধেই টানা চারদিন দরিদ্র রিকশা চালক খলিলের রিকশাটি আটকে রাখেন সেই মাইক্রোবাসের মালিক, জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু।
এ প্রসঙ্গে রিকশা চালক খলিল বলেন, নেতারা গরীব মানুষের পাশে আইসা দাঁড়ায়। বিশেষ কইরা করোনার সময় বরগুনার সব নেতারাই আমাগো মতো গরীবগো পাশে দাঁড়াইছে। হেইডা না কইরা হেই নেতায় আমার রিকশাটা চাইরডা দিন আটকাইয়া রাখছিল। আমি গরীব মানুষ আশ্রায়ণ প্রকল্পে পরিবার নিয়ে থাকি, কত অনুনয় বিনয় করছিলাম কিন্তু দেয় নাই। উপরন্তু আমার কাছ থেইকা জোর কইরা পাঁচশ টাহা জরিমানা রাখছে। আমি আমার এক আত্মীয়র কাছ দিয়া ধার কইরা টাকা আইননা দিছি।
খলিল আরো বলেন, হেই সময়ে কত মানষের হাতে পায়ে ধরছি, কইছি আমার রিকশাডা একটু ছাড়াইয়া আইনা দেন। অনেকেই হ্যার ধারে গেছে। কিন্তু হ্যাগো কতায় আমারে রিকশা ফেরৎ দেয় নায়। শ্যাষে বরগুনা শহরের এক ডাক্তার আফায় আছে। যে বেশিরভাগ সময় আমার রিকশায় আওয়া যাওয়া করেন। হ্যারে ধইরা চারদিনের মাথায় আমার রিকশাটা আমি ফেরৎ পাইছি।
এমপি টুকর আরেক অপকর্ম হচ্ছে— এমপি হওয়ার পরপরই গরীবের পেটে লাথি মারতে জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলামকে ব্যবহার করে বরগুনার আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে অটোরিকশা বন্ধের নোটিশ জারি করা। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, এমপি টুকুর নির্বাচনী জনসভাগুলোতে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতেন বরগুনা বাস মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা কিসলু। উপস্থিত থাকতেন সেই কমিটির সদস্যরা। তাই নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা থেকে বরগুনার মহাসড়কগুলোতে অটোরিকশা বন্ধ করান টুকু। কারণ, অটোরিকশা বন্ধ হলে মানুষ বাধ্য হয়েই বাসে উঠবে। তবে এ সিদ্ধান্তের কারণে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হলে রিকশা চালকদের সামনে বসে ফেসবুকে লাইভে এসে জেলা প্রশাসককে লোক দেখানো ফোন করে নোটিশটি প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন এমপি টুকু। যা বরগুনার মানুষদের ভেতরে হাস্যরসের খোরাক জোগায়।
এমপি টুকু তার সব থেকে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায় বরগুনার সাংবাদিকদের প্রধান সংগঠন ঐতিহ্যবাহী বরগুনা প্রেসক্লাবকে নিয়ে। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী টুকুর পক্ষালম্বন করেনি বরগুনা প্রেসক্লাব। ফলে বরগুনা প্রেসক্লাব নিয়ে টুকুর ক্ষোভ ছিল চরম পর্যায়ে। এ কারণে নির্বাচনের কিছুদিন পরেই প্রেসক্লাব দখলের উদ্দেশ্যে নিজের অনুগত সাংবাদিকদের পাঠিয়ে হামলা করান এমপি টুকু।
এ প্রসঙ্গে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক এক সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রেসক্লাবে হামলা করা হলেও তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সোহেল হাফিজের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় সে যাত্রায় মনোবাসনা পূর্ণ না হয় নি। কিন্তু হামলাকারীদের একজন কিছুদিন পরে মৃত্যুবরণ করলে এমপি টুকু বিষয়টি প্রচার করে— প্রেসক্লাবের হামলায় সাংবাদিকের মৃত্যু বলে!
তিনি আরও বলেন, এমপি গোলাম সরোয়ার টুকু পেশিশক্তি ব্যবহার করে এবং মৃত্যুবরণ করা সাংবাদিক মাসুদ তালুকদারের স্ত্রীকে প্রভাবিত করিয়ে প্রেসক্লাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করান। শুধুমাত্র সেই মামলার কারণে জেলার স্বনামধন্য সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন জেলহাজতে ছিলেন।
টুকু টাকা নিয়েছেন বরগুনার শহরের ভূমি মালিকদের কাছ থেকেও। এ প্রসঙ্গে বরগুনা শহরের এক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বাজারের ভূমির মালিকানা নিয়ে কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনের সাথে ভূমি মালিকদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আমাদের এ সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে শহরের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিলেও কিছুই করেন নি সাবেক এমপি টুকু।
মাত্র সাত মাসেই বরগুনায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা এই গডফাদার এমপিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বরগুনার কোথাও দেখা যায়নি। এলাকাবাসীরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। বরগুনা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এমপি টুকুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে।
